এঞ্জেল ফলস বা এঞ্জেল জলপ্রপাত বিশ্বের সর্বোচ্চ নিরবচ্ছিন্ন জলপ্রপাত।
ভেনেজুয়ালার এঞ্জেল জলপ্রপাতটির উচ্চতা ৯৭৯ মিটার বা ৩২১২ ফুট এবং গভীরতা ৮০৭ মিটার বা ২৬৪৮ ফুট।এটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের একটি অংশ।
জলপ্রপাতটি ১৯৩৭ সালে মার্কিন বিমান চালক জিমি এঞ্জেল আবিষ্কার করেন।
তাঁর নাম অনুসারে জলপ্রপাতটির নামকরণ করা হয়। স্থানীয় আদিবাসীরা অবশ্য জলপ্রপাতটিকে বলে “কেরেপাকুপাই মেরু”।
স্থানীয় আদিবাসীদের কথা মনে করে হুগো শ্যাভেজ জলপ্রপাতটির নাম পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন।
পৃথিবীতে অনেক ধরনের জলপ্রপাত আছে।যেমন-ভিক্টোরিয়া,নায়াগ্রা,ইগুয়াজু,ক্যাইয়েটুর,বান জিওক-ডেটিয়ান ইত্যাদি জলপ্রপাত।
কিন্তু এঞ্জেল ফলসের আছে এমন ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যা অন্য যে কোনোটি থেকে অালাদা।এটি এমন একটি জলপ্রপাত যার পতনের শব্দের কাছে পৃথিবীর সবচাইতে জোরালো গর্জনটি ও তুচ্ছ।
পাহাড়সম সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ যার কাছে হার মেনে যায়। অকল্পনীয় উচ্চতায় জলপ্রপাত যার চূড়া, মেঘের চেয়েও উপরে। যা দেখলে মনে হয়, স্বর্গ থেকে নেমে আসছে জলধারা।আবার যার অর্ধেকটা ধরণীতে নেমে আসার আগেই মেঘে পরিণত হয়। রঙধনুর দেখা মেলে তাকে ঘিরে,অপরূপ রূপসী সে দৃশ্য।
রুপসীর চারিদিকে অদৃশ্য বেড়াজাল।ব্যাপারটা এমন যে তার বেশি কাছেও যাওয়া যায় না, আবার দুরেও থাকা অসম্ভব।
যেনো প্রেমিকার গভীর প্রেমে অবগাহন।মনূষ্য-প্রকৃতির প্রেম মিলেমিশে একাকার।
এমন রূপ সৌন্দর্যের বিশালতা মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকলেও দেখার পিপাসা মিটে না।
পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু জলপ্রপাত এঞ্জেল ফলসটি ভেনেজুয়েলার “কানাইমা ন্যাশনাল পার্কে” অবস্থিত। “আয়ুয়ান তেপুয়” পর্বত থেকে সৃষ্ট। পার্কটিও পৃথিবীর তৃতীয় সর্ববৃহৎ পার্ক এবং ইউনেস্কো স্বীকৃত ওয়ার্ড হেরিটেজ সাইট।
উচ্চতার দিক দিয়ে প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের তিনগুণ।
স্থানীয় ভাষায় “আয়ুয়ান” শব্দের ইংরেজি অর্থ ডেভিল আর “তেপুয়” অর্থ মাউন্টেন। ডেভিল মাউন্টেন থেকেই এঞ্জেল ফলসের সৃষ্টি।
জিমি ক্রাওফোর্ড এঞ্জেলের এঞ্জেল ফলস আবিষ্কারের কাহিনী কোনো হলিউড মুভি কিংবা রোমাঞ্চকর ফিকশন নোবেলের চেয়ে কম নয়।
প্রকৃতপক্ষে জিমি চুক্তিসাপেক্ষে স্বর্ন খুঁজছিলেন “রিভার অফ গোল্ড “নদী থেকে।
সেবার স্বর্ন কুড়িয়ে পকেট ভর্তি করে সন্ধ্যার পূর্বেই আকাশে উড়াল দেয়।কিন্তুু জিমির মনের কোনে থেকে যায়,”আয়ুয়ান-তেপুয়”তেই”রিভার অফ গোল্ডের” অবস্থান।
জিমি এঞ্জেল ডেভিল ক্যানিয়নের উপর দিয়ে একাই বিমান চালানোর সময় অবিরাম বৃষ্টি ও মেঘের মধ্যদিয়ে এক পলকের জন্য এঞ্জেল ফলস দেখে ফেলেন।
বিষয়টা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে, এটা জলপ্রপাত হতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে তার সাথেই থাকা সঙ্গী মাইনিং অফিসিয়াল ডি.এইচ.কারি ও মেক্সিকান মেকানিক ও কো-পাইলট হোসে কারদোনাকে বললে তারাও অবিশ্বাস করে।
২৪ মার্চ ১৯৩৫ সালে জিমি এঞ্জেল ফলসের অস্তিত্ব দেখান। ১৯৪২ সালে ডেনিসন এই অ্যাডভেঞ্চারের উপর প্রকাশিত “ডেভিল মাউন্টেন” বইয়ে বিস্তারিত লিখেন।
কিন্তু এরপরও এই অভিযানের কথা কেউ বিশ্বাস করেনি।এরপর তার সঙ্গীরা নিউয়র্কের জিমি, ডুরাল্ড এ. হল ও এল. আর. ডেনিসন ছবি উঠান তার বন্ধু এফ. আই.শর্টি মার্টিন যিনি ছিলেন আমেরিকান পেট্রোলিয়াম জিওলজিস্টের সহযোগিতায়।১৯৩৪ সালে এঞ্জেল ফলসের ছবিতে কিছুটা বিশ্বাসযোগ্যতা পায়।
১৫ বছর পার হয়ে গেলেও জিমির মাথা থেকে “রিভার অফ গোল্ডেন” ভাবনা মুছে যায়নি। তিনি জলপ্রপাতের উৎস খুঁজছিলেন অর্থাৎ নদী। তার আবারও অভিযান দরকার ছিল। এর মাঝে জিমি একটি “ফ্লামিংগো” বিমান কিনে নাম রাখেন ‘এল রিও করোনি।’
১৯৩৭ সালের ৯ অক্টোবর আবারো বেরিয়ে পড়েন।
এই অভিযানে তার সঙ্গী ছিল এঞ্জেলের স্ত্রী ম্যারি এঞ্জেল, বন্ধু গুস্তাভো হেনী ওরফে ক্যাবুইয়া,হেনির গার্ডেনার ও বিভিন্ন সময়ে জঙ্গলে অভিযানের সঙ্গী মেগাল এঞ্জেল দেলগাদো এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ক্যাপ্টেন ফেলিক্স কারদোনা পুইগ।
এবারের অভিযানটি আরো কঠিন ছিল।অনেকে হাল ছেড়ে দিল কিন্তু জিমি হাল ছাড়েননি।
জিমি হেনির রেশন প্যারাসুটের মাধ্যমে প্রায় সফল হয়ে
গিয়েছিলেন। কিন্তু পাহাড়ের বিশাল দেয়াল বাধ সাধে।
অবশেষে আসে সেই মহেন্দ্রক্ষণ। বিমানের ল্যান্ডিং মসৃণ ভাবে হলেও বিমানের চাকা ভেঙে যায়। বিমানের মুখ থুবড়ে কাদা মাটিতে গেঁথে যায়। ফুয়েললাইনও ভেঙে যায়।
আশার প্রদীপটাও নিভে গেলো।কিন্তু জিমি তবুও হাল ছাড়েননি।”রিভার অফ গোল্ড” এর সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে।দুদিন খুঁজেও স্বর্নেরও কোনো খোঁজ না পেয়ে হতাশ ও ক্লান্ত হয়ে পড়েন। দীর্ঘ ১১ দিনের ক্লান্তিকর হাঁটাপথে পেয়ে যান সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এঞ্জেল ফলসের
দেখা পেয়ে যান। তাঁর চোখেই আবিষ্কৃত হয় “এঞ্জেল ফলস”।
আর তাই তার নামেই আজও জলপ্রপাতটি এঞ্জেল ফলস নামে পরিচিত।জীবনের অর্ধেকটা সময় তিনি এই প্রকৃতির স্বর্গ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় ব্যয় করেছেন।
বিস্ময়কর হলো যে সবার জানা মতে, জলপ্রপাতের উৎস কোন নদী, হ্রদ, বরফগলা পানির স্রোত অথবা মাটির নিচ থেকে উঠে আসা পানি।
কিন্তু এই জলপ্রপাতটির পানি প্রবাহের কোন উৎসই নেই। রেইনফরেস্ট অঞ্চলে সারাবছর যে বৃষ্টিপাত হয়, সেই বৃষ্টির পানি পাহাড় থেকে অনবরত গড়িয়ে পড়ে সৃষ্টি করেছে এই বিশাল জলপ্রপাত।
এক কিলোমিটার উঁচু থেকে এই বৃষ্টির পানি গিয়ে পড়ে নিচের “কেরিপ” নদীতে। সেখান থেকে আবার তা গিয়ে মেশে “চুরুন” নদীতে।আরও মজার ব্যাপার হলো এত উপর থেকে পড়া এঞ্জেল ফলসের বেশির ভাগ পানিই নিচে পড়ার আগেই বাষ্প হয়ে যায়। আর এ বাষ্পই জলপ্রপাতটির চারদিক থেকে একটি কুয়াশার আস্তরণ তৈরি করে। এখানেই এঞ্জেল ফলসের সৌন্দর্য।মেঘ, বৃষ্টির পানি,পাহাড় সবকিছু যেনো একসাথে মিশে যায়।
সৌন্দর্যের সাথে গর্জন অন্য যেকোন জলপ্রপাতের পতনের শব্দ এর কাছে তুচ্ছ মনে হবে।বিশাল সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দও এটির কাছে হার মেনে যায়। এই জলপ্রপাতের চূড়া মেঘের উপরে দেখে মনে হবে যেন স্বর্গ থেকে জলধারা নেমে আসছে। আর আশ্চর্য সুন্দর জলধারাকে ঘিরে তৈরি হয় রংধনু।এ যেন অপ্সরীর রূপের অমৃতধারা।রূপ, সৌন্দর্য, বিশালতা এমনই যা, যে কাউকে মন্ত্রমুগ্ধের মত বিমোহিত করবে।
প্রকৃত অর্থে এঞ্জেল ফলস আবিষ্কারের ঘটনাটি মুভির চেয়ে রোমাঞ্চকর।জিমি এঞ্জেল মূলত সোনার খনি খুঁজতে ১৯৩৭ সালে সেখানে গিয়েছিলেন। আর আবিষ্কার করে ফেলেন প্রকৃতির এক বিস্ময়কর সৌন্দর্য।
হলিউডের বেশকিছু সিনেমার ছবির দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে এই জলপ্রপাতে। ডিজনির অ্যানিমেটেড মুভি ‘আপ’ এর একটি দৃশ্যে এই জলপ্রপাত দেখা যায়। এছাড়া ‘ডাইনোসর’ এবং ‘পয়েন্ট ব্রেক’ নামে মুভিগুলোর কিছু দৃশ্য এই জলপ্রপাতটি দিয়ে চিত্রায়িত হয়েছে।
অতি দুর্গম এলাকায় অবস্থিত বলে এখানে যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য।তারপরও এখানে অনেক পর্যটক এর আগমন ঘটে।এখানে যেতে হলে প্রথমে পুয়ের্তো ওয়ার্দাজ অথবা সিউদাদ বলিভার বিমানবন্দর থেকে প্রথমে পৌঁছাতে হবে কানাইমা ক্যাম্পে।সেখান থেকে নদীপথে যেতে হবে এই জলপ্রপাতে। জুন থেকে ডিসেম্বর মাসে নদীতে নৌকা চলার মতো পানি থাকে।এটাই ভ্রমণের উপযুক্ত সময়।
কথিত আছে,সেই জিমি এঞ্জেল ১৯৫৬ সালের ৮ ডিসেম্বর মৃত্যুবরন করেন এবং তাঁরই ইচ্ছানুযায়ী জিমি এঞ্জেলের দেহভষ্ম এঞ্জেল ফলসেই ছিটিয়ে দেয়া হয়।
0 Comments