বেশ কয়েকদিন ধরেই পরমার মন মেজাজ ভালো নেই। সংসারের সব কাজ একা হাতে সামলাতে হিমসিম অবস্থা। অরিন্দমের যে কি হয়েছে সর্বক্ষণ কানে এয়ার বাড গুঁজে বসে আছে।
জীবন থেকে যেন সব কথা চলে গেছে। সাতবার ডাকলে একবার সাড়া দেয়। অথচ একসময় একটিবারের জন্যও পরমাকে চোখের আড়াল করত না। খুব প্রয়োজন ছাড়া দু’জন দু’জনকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেই পারত না। যত বয়স বাড়ছে দূরত্বও তত বাড়ছে। সবসময় মনোমালিন্য খিটিরমিটির লেগেই আছে।
সমস্যা কোথায় বুঝতে পারেনা পরমা। এইভাবে কি থাকা যায়! অরিন্দমের ব্যবহারে নিজেকে ভীষণ ছোট লাগে। অথচ কাকে বলতে যাবে এইসব কথা! ছেলে ঋষি সস্ত্রীক বিদেশে থাকে।
রাকা মেয়েটিও বেশ উচ্ছল সপ্রতিভ। প্রতিদিন রাত নটা বাজলে ভিডিও কলে কথা হয়। বেশ খানিকক্ষণ হাসিঠাট্টা চলে। সেদিন পরমার মনটা ভালো ছিল না। ঋষি বা রাকার কাছে তা সহজেই ধরা পড়ে। ঋষি
নাছোড়বান্দা—–
” বল না মা কি হয়েছে? বাবার
সঙ্গে ঝগড়া? বাবা কোথায়? আমি আজ বেশ কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছি তুমি বেশ
আনমনা। গান গাওয়া কি বন্ধ করে দিয়েছ?
গলা ছেড়ে গান করো দেখবে সব ডিপ্রেশন কেটে যাবে।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে
ঋষি।
পরমা মনে মনে বলে কে গান শুনবে? বিশ্বভারতীতে গান নিয়ে পড়াশুনা করতে গিয়েই অরিন্দমের সঙ্গে আলাপ, ভালোবাসা
তারপর বিয়ে। অপূর্ব গানের গলা। সুযোগ এসেছিল অনেক, শুধুমাত্র অরিন্দমের সঙ্গে
চুটিয়ে সংসার করবে বলে সেদিকে যায় নি।
আজ তার এই পরিণতি! মনে হয় পাছে পরমার গান শুনতে হয় তাই কানে এয়ার বাড গোঁজা। পরমার ভীষণ লজ্জা করে দু’কলি গাইতে।
সম্বিত ফেরে রাকার কথায় ——
“তোমাকে বলতেই হবে মণি। আমি আছি, দেখো না বাবিকে কেমন শাস্তি দিই।”
পরমা অনিচ্ছাসত্বেও সব কথা বলে ফেলে ” আমি আর এইভাবে দিনের পর দিন
থাকতে পারছি না। অনেক তো হল। তোদের
জানিয়ে রাখি আমি সেপারেশন চাইছি। এবার একটু নিজেকে ভালোবাসব। ”
বলতে বলতেই দু’চোখ ছলছলিয়ে ওঠে।
ঋষি বোঝে মা নিশ্চয়ই কোনো ঘটনায়
খুবই আঘাত পেয়েছে। চুপ করে যায়। কথা
ঘুরিয়ে বলে ——
” ডিনার হয়ে গেছে? তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ো। বেশি রাত কোরো না।”
রাতে হঠাৎ শোনে অরিন্দম ঋষির সঙ্গে
কথা বলছে——
“বড়দের ব্যাপারে নাক গলিও না। নিজেদের কাজ মন দিয়ে করো। সব ঠিক
হয়ে যাবে।”
কিন্তু কিছুই ঠিক হয় না। পরমা মনে মনে সব ঠিক করে ফেলে। সেপারেশনের পর সে বাড়ি থেকে ভাড়াটে তুলে দেবে। পরমা নীচের তলায় থাকবে আর অরিন্দম
দোতলায়। জীবনের শেষ বয়সটা একটু নিজের মতো কাটাবে।
সেদিন ডিনার টেবিলে হঠাৎই রাকার ভিডিও কল। অরিন্দম সোফায় বসে।পরমার পক্ষ নিয়ে ব্যঙ্গ করে হেসে লুটিয়ে পড়ে বলে —-“শোনো মণি বাবির সম্পর্কে কি লিখেছে…..”
—– “অরিন্দম হচ্ছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে
নির্লোভ মানুষ। সে কোনো বিনিময়ের আশা
ছাড়াই তার মন প্রাণ উজাড় করে দেয়। আপনার কোনো বন্ধুর প্রয়োজন হলে আপনি সর্বদা তার ওপর নির্ভর করতে পারেন। অরিন্দম হচ্ছে এক সত্যিকারের
সূর্যকিরণ! তার মন নিখাদ সোনার তৈরি।
ভালোবাসার মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে
তার বিকল্প নেই।…..”
রাকার কথা শেষ হলে ঘরে নেমে আসে
এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য। রাকা বারবার বলে
আর হেসে লুটিয়ে পড়ে।
পরমা বলে —-
“রাকা ফোনটা একটু রাখ। আমি হাত
ধুয়ে তোকে ফোন করছি।”
পরমা খাওয়া শেষ করতে পারেনি। সব কিছু ফ্রিজে তুলে রেখে হাত ধুয়ে ফোনটা
নিয়ে বসে। তারপর ছোট্ট এস. এম.এস……
” তোর বাবির সম্পর্কে যা লিখেছে তা সর্বৈব সত্য। যা বলব সত্য বলব।মিছা নাহি
বলব।”
রাকা বাকরুদ্ধ। কি বলছে মণি! ভেবেছিল মণিও মুখ বেঁকিয়ে বলবে যত সব মিথ্যে কথা! আর হেসে লুটিয়ে পড়বে। এসব কি লিখেছে! সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিন শট নিয়ে বাবিকে পাঠিয়ে দেয়। বাবি লেখে
—–” বলেছিলাম না বড়দের কথায় থেকো না।”
রাতে শুয়ে মাঝখানের পাশবালিশটা সরিয়ে দিয়ে অরিন্দম বলে——-
“আমার গায়ে পা দিয়ে শোও। ”
দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে বলে….” সেপারেশন কি চাইলেই পাওয়া যায়! তাহলে আমাকে গান
শোনাবে কে? মনে করো আমি তোমার গান
শুনি না। কানে এয়ার বাড থাকলেও মোবাইলের সুইচ অফ্ থাকে। তোমাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ পরমা।”
কোথায় সেপারেশন! কোথায় দুরত্ব!পরমা অরিন্দমের হাতের ওপর মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে।
ওদের রোজনামচায় এই ভালোবাসাটুকু থাক….
0 Comments