নদীর যেমন নানাদিকে ধারা চলে যায়, তাঁর ছিল তেমনি

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর


তা রবিকাকার লেখা দেশের লােক অনেকেই অনেককাল অবধি বুঝত না, উল্টে গালাগালি দিয়েছে। সেদিনও যখন আমি অসুখের পর স্টীমারে বেড়াই, তখন তাে আমি বেশ বড়ােই, এক ভদ্রলোেক বললেন, রবিবাবু যে কী লেখেন কিছু বােঝেন মশায় ? রবিকাকা বিলেত থেকে আসার পর দেখি তেমন আর কেউ উচ্চবাচ্য করে না। হয় কী, বড়াে একটা গাছের উপর হিংসে, সেটা হয়। বন্ধুভাগ্য যেমন ওঁর বেশি, অবন্ধুও কম নয়। | তা, সেই খামখেয়ালীর সময় দেখেছি, কী প্রােডাকশন ওঁর লেখার, আর কী প্রচণ্ড শক্তি। নদীর যেমন নানাদিকে ধারা চলে যায়, তাঁর ছিল তেমনি। আমাদের মতাে একটা জিনিস নিয়ে, ছবি হচ্ছে তাে ছবি নিয়েই বসে থাকেন নি। 

একসঙ্গে সব ধারা চলত। কংগ্রেস হচ্ছে, গানবাজনা চলছে, নাচও দেখছেন, সামান্য আমােদ-আহাদ-আনন্দও আছে, আর্টেরও চর্চা করতেন তখন। ওই সময়ে আমাকে মাইকেল এঞ্জেলাের জীবনী ও রবিবর্মার ফোটোগ্রাফের অ্যালবাম দিয়েছিলেন। | খেয়াল গেল ছােটোদের স্কুল করতে হবে। নীচের তলায় ক্লাস-ঘর সাজানাে হল বেঞ্চি দিয়ে, ঝগড়ু চাকর ঝাড়পোঁছ করছে, ঘণ্টা জোগাড় হল, ক্লাস বসবে। কোখেকে মাস্টার ধরে আনলেন। কোথায় কী পাওয়া যাবে, রবিকাকা জানতেনও সব। হাল্কাভাবে কিছু হবার জো নেই, যেটি ধরছেন নিখুঁতভাবে সুসম্পন্ন করা চাই। 

ছেলেদের উপযােগী বই লিখলেন, আমাকে দিয়েও লেখালেন। ওই সময়েই ক্ষীরের পুতুল’ শকুন্তলা ওইসব বইগুলি লিখি। নানা জায়গা থেকে বাল্যগ্রন্থ আনালেন। | প্রকাণ্ড ইনটেলেকট, অমন আমি দেখি নি আর। বটগাছ যেমন নানা ডালপালা ফুলফল নিয়ে আপনাকে প্রকাশ করে রবিকাকাও তেমনি বিচিত্র দিকে ফুটে উঠলেন। যেটা ধরছেন এমন-কি ছােটোখাটো গল্প, তাতেও কথা কইবার জো নেই, সব-কিছু এক-একটি সম্পদ। লােকে বলে এক্সপিরিয়েন্স নেই, কল্পনা থেকে লিখে গেছেন, তা একেবারেই নয়। লােকে খামখেয়ালীর যুগে থাকলে বুঝতে পারত। মাথায় এল ন্যাশনাল কলেজ কী করে করা যাবে। তারক পালিত দিলেন লক্ষ টাকা, স্বদেশী যুগের টাকাও ছিল কিছু, তাই দিয়ে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনষ্টিটিউট নামে কলেজ খােলা হল। তাতে তাত চলবে, দেশলাইয়ের কারখানা আরাে সব-কিছু থাকবে। কলেজ চলছে, মাঝে মাঝে কমিটির মিটিং বসে।

 এখন, এক কমিটি বসল বউবাজারের ওখানে একটি বাড়িতে। রবিকাকা গেছেন, আমরাও গেছি, ভােট দিতে হবে তো মিটিঙে। স্যার গুরুদাস বাঁড়ুজ্জে সভার প্রেসিডেন্ট, ইচ্ছে করেই ওঁকে করা হয়েছে, তা হলে ঝগড়াঝাটি হবে না নিজেদের মধ্যে। কোনাে প্রস্তাব হলে উনি দু-পক্ষকেই ঠাণ্ডা রাখছেন। রবিকাকা সেই মিটিঙে প্রস্তাব করলেন এমন করে কলেজের কাজ চলবে না। প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিঙের দরকার। ছ-সাতটি ছেলেকে খরচ দিয়ে বিদেশে জায়গায় জায়গায় পাঠিয়ে সব শিখিয়ে তৈরি করে আনা হােক। খুবই ভালাে প্রস্তাব। প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিঙের খুবই প্রয়ােজন, নয় তাে চলছে না। সে মিটিঙে আর-এক জন পাল্টা প্রস্তাব করলেন, তিনি এখন নাজানা প্রফেসার, তার দরকার কী মশায়। বই আনান, বই পড়ে ঠিক করে নেব।'  শেষে সেই প্রস্তাবই রইল। 

আমরা সব অবাক। রবিকাকা চুপ। এই রকম সব ব্যাপার ছিল তখন। রবিকাকার স্কীমের ওই দশা হত। বাধা পেয়েছেন অনেক, অন্যায় ভাবে। সেই সময় থেকেই বােধ হয় ওঁর মনে মনে ছিল যে নিজেদের একটা-কিছু না বলে হবে না।। শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্য আশ্রমে রবিকাকা নিজের মনের মত ফ্রি স্কোপ পেলেন। জমিজমা পুরীর বাড়ি এমন-কি কাকীমার গায়ের গয়না বিক্রি করে শান্তিনিকেতনে সব ঢেলে দিয়ে কাজ শুরু করলেন।    -- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

Post a Comment

0 Comments