আত্মবাচক বকবকম // তৈমুর খান


.
sahityakaal.com

.


কবিতা নিয়ে ঘরকন্না! 




সুখের ঘর করি না, আমরা দুখের ঘর করি। অভিমান হয়, কাঁদি। কেঁদে কেঁদে আবার হাসিও। শরতের এক পশলা বৃষ্টির পর আকাশ যেমন ঝকঝক করে ওঠে, কাশফুলে বাতাসের দোলা লাগে, আমরাও তেমনি শরতের বিকেল হয়ে যাই।
.


নদীর তীরে শামলা গাই তার বাছুর হারিয়ে যেমন হাম্বা হাম্বা করে ডাকে, আমরাও ডাকতে থাকি নিঃশব্দে আমাদের মন্থনের শব্দকে। সারাদিন সংসারে যায়, মায়ায় যায়, কর্তব্যে ও দায়িত্বে যায়, এর ফাঁকে ফাঁকেই কত যুদ্ধ করি। সেসব যুদ্ধ থেকেই তুলে আনি মৃত ও জীবিত আত্মাদের।

.


শব্দের অবিনশ্বর পাথরে প্রতিটি মুখ দেখতে চাই। কত শত মুখ, মুখের মিছিল। কবিতা গড়তে থাকি নিজস্ব নিয়মেই, নিজেকে ক্ষয় করে করে । সন্ধে হয়ে এলে নিজের ভেতরের “আমি”টিকে একবার তাড়া দিই –“চলো গো, একবার সাদা কাগজের সামনে বসি!”

.


       পৃথিবীতে কত রকম মানুষ থাকে, কত কত তাদের সাধ্য ও সামর্থ্য। আমাদের কিছুই সামর্থ্য নেই। জল গড়িয়ে কত দূর চলে যাচ্ছে, তরঙ্গ উঠে কত তীরভূমি ভেঙে ফেলছে। কত প্রেম গল্প তৈরি করছে। কত উৎসব আলো-অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। যুদ্ধ-ধ্বংস-মৃত্যুর যন্ত্রণায় কত রাষ্ট্র কাতর হচ্ছে।




আমরা সেখানে পৌঁছাতে পারি না। নিজের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হৃদয়ের সীমানায় আত্মগত কোনো অনুভবের দরজায় উপনীত হই আর নিজেকেই বুঝতে থাকি। আকাঙ্ক্ষার পাদদেশে কোনো স্বর্ণময় স্বর্গের মানবিক বিকিরণে উজ্জ্বল হবার সাধনায়।
.

.



কেন না, দানবের এ-কালসমারোহ লীলায় মানব সব সময় পর্যুদস্ত, ইহকালের সংকট রিরংসায় প্রজ্জ্বলিত আগুনে নিক্ষিপ্ত । সেখান থেকে মুক্তি চেতনার নিবিষ্ট সূত্রটির অন্বেষণই আমার দর্শন।.


পত্রিকা কি কবিতাকে বাঁচিয়ে রাখে ? 


তবু এ প্রশ্নটিই বারবার আঁড়ি পাতে। পত্রিকা একটা মাধ্যম তো। প্রচার করা, পৌঁছে দেওয়া। পত্রিকার ওপর ভরসা সেই কারণেই। কিন্তু বাঁচিয়ে রাখতে পারে কই? একজন কবি তথা সম্পাদক যখন কোনো প্রকাশনার পৃষ্ঠপোষকতায় কোনো পত্রিকা সম্পাদনা করেন তখন নিজের আত্মপ্রচারের জায়গাটিই পাকা করে নেন।

.


অন্যরা তখন ফালতু মানুষ। “নিজের পয়সা খরচ করে পত্রিকা করি, কার লেখা ছাপব, কার ছাপব না তা আমার ব্যাপার!” সম্পাদকের যখন এ-হেন বক্তৃতা শুনি তখন সেই কবি কতখানি কবি এবং কতখানি ভালোমানুষ সে সম্পর্কে সন্দেহ হয়। কবি এবং ভালোমানুষের মাঝখানে “হৃদয়” নামক একটা শব্দ বিরাজ করে। সহৃদয় হৃদয়সংবাদী ব্যক্তিই কবি এবং সহৃদয় হৃদয়বান ব্যক্তিই ভালোমানুষ।


.


দুই সমীকরণের এই একই উত্তর থেকে এই কবিতা-শিল্প ও আচরণটি প্রযুক্ত হয়েছে। তখন ওই কবি ও সম্পাদক অসফল এবং অকবিও। অবজ্ঞার দীপ্তি ওঁর চোখে মুখে খেলা করে। শয়তানি অন্ধকার অট্টহাসির তামাশা রচনা করে।

.


যতই ছন্দ ঠিক হয় হোক, কবিতা তখন আমাদের কাছে হৃদয়ের আবেদন হারিয়ে শরীরের অন্তর্গত খাদ্যনালী থেকে উগরে আসা শব্দের মতো। কবিদের মধ্যে এরকম তো অনেক personality মিশে আছে । আমাদের অভিমানকে ওরা নরম ক্ষুর চালিয়ে কেটে ফেলে। মানবিকতার এক ঝলক অন্তরায় সংলাপেই বেরিয়ে আসে।

.


কবিতার ভালোমন্দ কী ? 



এ প্রশ্ন সর্বত্রই। যেখানেই গেছি, যার যেমন আয়োজন সবাই আপ্যায়ণ করেছেন, কিন্তু “কবিতা ভালো হয়নি” কথাটি পেছন ছাড়েনি । যখন সিংহাসনে বসেছি তখন “ভালো হয়নি” নামের লোম ওঠা ঘৃণ্য কুকুরটিও আমার পাশে এসে লেজ নেড়েছে। তা ভালো, বাপু, কহ-তো ভালো কবিতা কাহারে কহিবে ?

.


খারাপ কবিতাই বা কাকে বলে? ছন্দ ঠিক আছে, অভূতপূর্ব শব্দ ব্যবহার, চিত্রকল্পও অনাস্বাদিত, ব্যক্তিও ব্যষ্টি হয়ে গেছে ; বাস্তবতা আছে, পরাবাস্তবও ; দর্শন আছে, দৃশ্যও ; truth আছে, feelingও। তা হলে ইহারে কী কহিবে? নৈব চ নৈব চ উত্তর। ভালো-খারাপ জানতে পারিনি। যেদিন প্রেমিকা ছেড়ে চলে গেল, যেদিন আমি নবকুমার হয়ে গেলাম, সেদিনই আমাকে প্রকৃত কবি মনে হল। লিখলাম :

.


সিঁড়ি দিয়া নামিতে নামিতে জীবন মিথ্যা হইয়া গেল।

মিথ্যা জীবন লইয়া কোথা যাই?

সম্রাট হইলাম না। যোদ্ধা হইলাম না।

কিংবদন্তির অভিনেতা অথবা রাজনীতিবিদও হইলাম না।

দুঃখের জল ঘেঁটে ঘেঁটে শব্দের পাথর কুড়াইলাম।

পাথরে চাঁদের ছবিও ফুটিল না।

সূর্যের রশ্মিও জাগিল না।

অন্ধ হইয়া মাটিতে দাঁড়াইলাম।

মাটি ফাঁক হইয়া আমাকে আশ্রয়ও দিল না।

শুধু বিক্ষুব্ধ জনতার ঢেউ আসিতে লাগিল।

পাহাড় চূর্ণ হইয়া নদী বহিতে লাগিল ।

সভ্যতা হাসিল ।

আমিই শুধু তরঙ্গ বিক্ষোভে হারিয়ে যাওয়া কপালকুণ্ডলাকে

খুঁজিতে লাগিলাম।


যেদিন সংসারের মায়াবন্ধনে আমি জাদুকরের ভেড়া হয়ে গেলাম সেদিনই আমাকে প্রকৃত কবি মনে হল। লিখলাম :


.

.


মেঘ সরিল না। সূর্য উঠিল না।

দুঃখের খামারে পড়িয়া রহিলাম।

রাজকন্যা আসিল না। জাদুকর ভেড়া বানাইয়া রাখিল।

সিংহাসন লইব না শুধু রাজকন্যাকে দেখিব।

বিবাহ করিব না শুধু স্পর্শ করিব।

আদেশ করিব না শুধু সেবা করিব।

ভোগ করিব না শুধু ত্যাগ করিব।

কিন্তু কিছুই হইল না, ভেড়া হইয়া জীবন কাটাইলাম।

কথা বলিতে গিয়া ভাষা পাল্টাইল।

মাথা উঁচু করিতে গিয়া মাথা নীচু হইল।

দু পায়ে হাঁটিতে গিয়া চাবুক খাইলাম।

ইজ্জৎ ঢাকিতে গিয়া হাস্যাষ্পদ হইলাম।

গায়ে লোম গজাইল। পায়ে খুর হইল ।

ছোট একটি লেজ নাড়িয়া নাড়িয়া মাছি তাড়াইলাম।


.

.


       অন্তরের সৎ ও সত্য অনুভূতিকে অকৃপণভাবে ভাষা দেবার প্রয়াস এবং আবহমান কালের অতীতকে নিজের ভেতর সমানুপাতিক করে এক সমাপতনে নেমে আসার ক্রিয়াটি সযত্নে সাধন করেছি। সেখানে কৃত্রিমতা নেই। বিষণ্ণ দুর্জয় দাহ, অন্তরের অতৃপ্তির উপর্যুপরি করাঘাত, সাকুল্যে বেঁচে ওঠার ও সর্বসংকটে মুক্তির আত্মচেতনায় আর্তসেবায় পরাগমোচন আনার দাবি নিয়েই শব্দে দ্রবীভূত। ভালোমন্দ বুঝিতে পারিলাম না। তোমরাই শুধু কহিলে “ভালো হয়নি”! কই কহিলে না “মন্দ হইয়াছে”!.

.


এও কি অসুখ ? 




প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পাইনি। অসুখের মতো, না নেশার মতো? কবিতা আমাকে পায়, না কবিতাকে আমি পাই? অথচ অসুখের মতোই মনখারাপ জমা হয়। নিজেকে ভর্তি করি শব্দের হাসপাতালে। মনন নামে কত ডাক্তার-নার্স দিনরাত সেবাশুশ্রূষা করে। ছন্দের পথ্য পাতলা করে খেতে দেয়। তার সঙ্গে আর সব কী কী ভিটামিন থাকে। বুঝতে পারি না। সারারাত গড়তে গড়তে কালিদাস হয়ে যাই। সংস্কৃত জানি না।
.

.


কালিদাসকে কোনোদিন দেখিনি। তবু মেঘের দূত হওয়া ভাবি। আর দেবী দুর্গার অকাল বোধনে কী করে আসে শারদীয়া দেখি। একবার জয়দেব হই, ভাবি জয়দেবই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। দেহি পদপল্লব বলে প্রেমিকার পা বুকের ওপর নিয়ে…..। গ্রামে ঢোকার মুখে কাঁচা রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজেকে কখন মনে হয়েছে ওয়ার্ডসওয়ার্থ।
.

.


Westminster Bridge থেকে দেখছি কেমন ভোর হচ্ছে শহরে! আরে আমার গ্রামটি কবে শহর হয়ে গেছে! কিছু ভেবে পাই না। শুধু অনুভব করি বিরাট আত্মাটি ঘুমোচ্ছে –“And all that mighty heart is lying still!”. কোনো কোনোদিন একটু বেশি পেলে বেশি খাই। তখন এস টি কোলরিজের Kubla Khan…. ওঃ কত যে রহস্যময় নাচ! চারপাশে প্রেতিনীদের সঙ্গে, গার্হস্থ্য অন্ধকারে ডুবে যাই। অসুখ-টসুখ বুঝি না, দুঃখ-কষ্টের স্রোতে দু চারটে আনন্দের মাছ ধরি। আমরা তো ভালো থাকতে চাই। আমরা তো আরোগ্য চাই! “Where was heard the mingled measure.”


.

.

Post a Comment

0 Comments