ক্লাস নাইনটেনের যত বন্ধুরা ছিল সব্বাই মিলে একটা হোয়াটস্আপ গ্রুপ খোলা হয়েছে, হ্যাঁ আমিও আছি তারমধ্যে। প্রায় পঁচিশবছর পরে আমাদের সবার মধ্যে এই যোগাযোগ। আমি আর আমার মতো দুএক জন ছাড়া বেশীর ভাগই এখানে মানে আমাদের এই ছোট্ট শহরটাতে আর থাকেনা। দেশবিদেশের বিভিন্ন ছোটবড় শহরে সব ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে। আমাদের সুধীন কিভাবে যেন যোগাযোগ করে সবাইকে এই এক অ্যাপের মধ্যে নিয়ে এসেছে।
ডিজিটাল পুনর্মিলনের উচ্ছ্বাসপর্ব মিটলে সবার এখনকার জীবনযাপনের খোঁজখবর দেওয়ানেওয়া চলল পরস্পরের মধ্যে, তারপর সকলে নিজের নিজের বৌবাচ্চাদের পারদর্শিতা, তাদের গুন, তাদের কর্মদক্ষতার গল্প করতে থাকি, বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির পর্যালোচনাও অবশ্য বাদ যায় না। এই সমস্ত কিছুর মাঝে কিন্তু ভীষণ ভাবে এসে পরে সেই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। বেশ বোঝা যায় প্রত্যেকেই ভীষনভাবে মিস করে কিশোরবেলার সেই দিনগুলোকে, সব্বাই যেন ফিরে যেতে চায় ঐ দিনগুলোতে।
সকলেরই অদ্ভুত এক আকুলতা সেই সময়টাকে ছুঁতে চাওয়ার, ছোট থেকে একটু একটু করে বড় হওয়ার সাক্ষী এই শহরটাকে ছুঁয়ে দেখার । সেইসময়কার নানারকমের গ্রুপফটোর আদানপ্রদান আর তার সাথে যুক্ত টুকরো স্মৃতিগুলোকে বারবার উল্টেপাল্টে যেন সময়টাকেই ফিরে পাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে ওরা।
সেদিন অর্চি একটা ছবি পোস্ট করল গ্রুপে। অযোধ্যা পাহাড়ের, সব বন্ধুরা মিলে একসাথে তোলা একটা গ্রুপ ফটো। ক্লাস টেনের টেস্টের পর ক্লাসের সব ছেলেদের এক্সকারসানে নিয়ে গিয়েছিলেন অ্যাসিস্টেন্ট হেড স্যার সুনির্মলবাবু। ফটো দেখে সবাই একেবারে উত্তেজিত, মুখর, কে কি বলেছিল, বাসে যাবার সময় সকলে মিলে কি গান করেছিল, ঐ সেই ঝর্নাটার মধ্যে কত্ত হুটোপুটি….সেই এক্সকারশনের শত মুহূর্তের কত কত স্মৃতিকে আবার মনে করা আবার ফিরে দেখা! আমি নিশ্চুপ। কারন ঐ এক্সকারসানে যেতে যে নূন্যতম ফি দিতে হত তা দেবার সামর্থ্য তখন আমার ছিল না। আমার মনে আছে আমি বলেছিলাম ‘আমার মায়ের খুব অসুখ হয়েছে, এখন আমার যাওয়ার খুব অসুবিধা।’ স্যার আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন ‘ ঠিক আছে মায়ের অসুখ সেরে গেলে বলিস আমি তোকে একযায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাবো।’ আমিও এই বিষয়টা স্যারকে কোনদিন মনে করাইনি স্যারও নিশ্চয়ই ভুলে গিয়েছিলেন।
এরমধ্যে বন্ধুরা সব আলোচনা করতে লাগল সেই কিশোরবেলার মতো সবাই মিলে একসাথে যদি আবার যাওয়া যায় ঐ অযোধ্যা পাহাড়ে তবে কেমন হয়! শেষে এমনটা দাঁড়ালো যে সক্কলে একসাথে যেতেই হবে ওখানে, নাহলে যেন এ জীবনটাই বৃথা যাবে। আমার উপর দায়িত্ব পড়ল এই ট্যুরের সবকিছুর ব্যবস্হা করার। এটা করা আমার কাছে খুব সহজ কারন গত সাত আট বছর ধরে প্রতি দোলের সময় আমি বাড়ীর সবাইকে নিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ে বেড়াতে যাই।
বন্ধুদের মনে হতে লাগল কেবলমাত্র এই ডিজিটাল যোগাযোগেই ওরা যদি এতটা স্মৃতিমেদুর, এতটা নস্টালজিক হয়ে ওঠে, তবে সামনাসামনি দেখা হলে না জানি কি হবে।
আমার কিন্তু এরকম কিচ্ছু মনে হয়না। স্মরণবেদনা বা নস্টালজিয়ার কোন অনুভবই আজ পর্যন্ত আমার হয়নি। যে সঙ্গ যে সময়ের জন্য ওদের এত অভাববোধ আমার কিন্তু সেই সময়কার বা তার সামান্য আগেপরের সেইরকম কোন ভালোলাগার স্মৃতি আমি মনে করতে পারিনা যেটাকে আমি মিস করতে পারি।
ঐ সময়টাতে আমার জীবন ছিল একমুখী আর কঠিন সংঘর্ষের। তখন বাবার ব্যাবসায় লস, প্রচুর দেনা, চরম দারিদ্রতা, কোন প্রাইভেট টিউটর ছিলনা, নিজে নিজে সারাদিন পড়তাম, খেলতে যেতাম না, ভাবতাম আমার কোন টিউটর নেই তাই আমাকে পড়া ভালো করে বুঝতে হলে আরো বেশী করে পড়তে হবে খেলাধুলায় সময় নষ্ট করা যাবে না। ভালো জামা ছিলনা তাই বন্ধুদের সাথে উৎসব আনন্দে যোগ দিতে যেতাম না, এক সেই রঙচটা পুরোনো জামা পরে যেতে বড় লজ্জা করত। যতদিন পর্যন্ত না সঠিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি চালিয়ে গেছি এই সংঘর্ষ। সেই সংঘর্ষ সেই সংযমের ফল এই যে আজ আমি খুব সম্মানের সাথে প্রতিষ্ঠিত আমাদের এই সুন্দর ছোট্ট শহরটাতে। আমি এই শহরেরই সেরা উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের প্রধানশিক্ষক। বাবামা আর স্ত্রীসন্তানকে নিয়ে ভীষন সুখের জীবনযাপন। চলে যাওয়া সেইসব সময়ের তুলনায় সবদিক থেকে আজ আমি অনেকগুন বেশী আনন্দে সুখে আছি। তাই পুরোনো দিনগুলোকে নিয়ে কোন অভাববোধই আমার ভিতর কাজ করে না। কোনভাবেই কোনোমতেই ফিরে যেতে চাই না সেই দিনগুলির স্মৃতিতে। তাই নস্টালজিয়া শব্দটার সাথে আমার অনুভূতির বিশেষ কোনো যোগ নেই। সেইজন্যই বন্ধুরা যখন ভাবাবেগে হারিয়ে যায় তখন আমি বুঝতে চেষ্টা করি কেমন সেই অনুভূতি।
এই সমস্ত কিছুর ফাঁকে আমাদের দেশেও শুরু হয়ে গেল করোনার প্রকোপ, তারপরে লকডাউন। অফিস,স্কুল কলেজ বাজারহাট সব বন্ধ। অনেকদিন বাড়ীতে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছে শরীরে আর মনে যেন মেদ জমে গেছে। তাই শরীরমন চাঙ্গা করার প্রয়োজনে প্রতিবেশীর সঙ্গে বেড়লাম প্রাতঃভ্রমনে, অপেক্ষাকৃত নির্জন স্থান দিয়ে একটু হাঁটবার উদ্দেশ্যে। আমাদের এই শহরটার একেবারে শেষ প্রান্ত দিয়ে একটা খাল চলে গিয়ে জলঙ্গি নদীতে মিশেছে। একসময় সেচের প্রয়োজনে সরকার এই খাল তৈরী করেছিল, খালের ধারে ধারে ছোট্ট ছোট্ট বাংলোর মতো কর্মচারীদের কোয়ার্টার। ঐখানে একটা কোয়ার্টারে আমার জেঠিমার একজন বান্ধবী থাকতেন, জেঠিমা ওখানে বেড়াতে গেলে পাঁচ-ছয় বছরের আমাকে নিয়ে যেতেন, কোয়ার্টারগুলোর প্রতিটার সামনে ছিল ফুলের বাগান। প্রতিটা বাগানে গোলাপ বেলী যুঁই আর শীতকালে মরশুমী ফুলেরা যেন হাসতো। খালের ধার দিয়ে সার বেঁধে সব ফলের গাছ, আম সবেদা গোলাপজাম আর জামরুল। ফুলফলের মিষ্টি গন্ধ আর খালের জলের তির তির করে বয়ে যাওয়া ছোট্ট আমার ভিতরটা কি যেন এক ভালোলাগায় ভরিয়ে দিত। আমার খুব ভালো লাগতো ওখানে যেতে। আজ বহুবছর পর হাঁটছি খালপাড়ের ঐ রাস্তা ধরে। সেইসব আম গোলাপজাম আরও সব গাছগুলো সেইরকমই আছে, ঠিক সেইরকম কোন কোন গাছে ফল ধরে আছে সেই ফলের কীই মিষ্টি গন্ধ! সেই খালের জলের তিরতির বয়ে যাওয়া…. একটা গাছতলায় বসে খালের ওপারের সবুজ চাষের জমির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার ভিতরে কি এক দারুন ভালোলাগায় ভরে যেতে লাগল সেই ছোট্ট বেলার মতো। মনের মধ্যে একটা পরিপূর্ণ ভালোলাগার অনুভূতি নিয়ে হাঁটতে লাগলাম ফুলের বাগানঘেরা কোয়ার্টারগুলোর দিকে। এগিয়ে যেতে যেতে মনে হতে লাগল এদিকটায় কেমন যেন একটা বন্য নিস্তব্ধতার গন্ধ। এই গন্ধটা কিন্তু ছোটবেলায় পেতাম বলে মনে পড়ছে না। তখন বরং ঐযে তুমুল বৃষ্টির পর রোদ উঠলে চারিদিকে কেমন উজ্জ্বলতা উচ্ছলতার গন্ধ ছড়িয়ে পরে সেই গন্ধটা পেতাম।
রাস্তাটার দুপাশে মেহেদি গাছের বেড়া। খুব সুন্দর করে ছাঁটা থাকত বেড়াটা তখন। আজ দেখছি সেই মেহেদি গাছ রয়েছে কিন্তু শৃঙ্খলাবদ্ধ বেড়া হিসাবে নেই। কোন যায়গায় অতিরিক্ত বেড়ে গেছে গাছ আবার কোথাও বোধহয় মেহেদিপাতা দিয়ে হাত রাঙাবে বলে অবাঙালিরা গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে গেছে। চারিদিক আগাছায় ভর্তি। দেখে খারাপ লাগল। এগিয়ে চললাম, খুব ইচ্ছা হল ছেলেবেলার সেই জেঠিমার বান্ধবীর বাড়ীটা দেখে যেতে, যদিও জানি ওনারা এই শহরেরই অন্য প্রান্তে বাড়ী করে চলে গেছেন। তবুও আমি ঐ সময়টাকে ফিরে পেতে চাইছিলাম, মনের মধ্যে একটা প্রচন্ড আকুতি তৈরী হচ্ছিল সেই সময়ের সব কিছু ঐভাবে দেখার, ছেলেবেলার সেই অনুভূতিটাকেই আবার ফিরে পাবার। হাঁটছি আর খুঁজছি কোথায় যেন? ভুল তো হবার নয় একটাই তো রাস্তা!
অবশেষে পেলাম খুঁজে। শুধু শ্যাওলা ধরা দেওয়ালগুলো রয়েছে। ছাদ বোধহয় ভেঙে গেছে কবেই। আগাছায় ঢেকে গেছে সবটুকু। কোনদিনও যে একটা সুন্দর ফুলের বাগান ছিল মনেই হবে না।
আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি, চেষ্টা করছি বোঝার কোথায় যেন সেই বারান্দাটা যেখানে মাদুর পেতে বসে জেঠিমা আর ওনার বান্ধবী গল্প করছেন আর আমি কুয়োতলার ধারে আমগাছে ঝোলানো টিঁয়া পাখির খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে পাখিটাকে দেখছি। পাকা আমের মিষ্টি গন্ধে চারিদিক ম ম করছে। বাঁধানো কুয়োতলার চারিদিকের মাটিতে সাদা নয়নতারা ফুটে গাছগুলো একেবারে সাদায় সাদা সবুজ দেখাই যাচ্ছে না। বাগানে গ্রীষ্মের সব সাদা ফুল বেলী স্বেতকরবী ফুটে আছে। চারিদিক কি ঝকঝকে পরিষ্কার, একটা আগাছা একটা শুকনো পাতা কি একটুও নোংরা নেই। গাছ থেকে লিচু পেড়ে দিয়েছেন ঐ মাসীমা আর আমি খাচ্ছি। ‘দাদা এই খানে আপনি? আমি খালের ধারে দাঁড়িয়ে খালের ওপারটা দেখছিলাম পিছন ফিরে দেখি আপনি নেই। খুঁজতে খুঁজতে এখানে এই ভাঙাবাড়ীটার মাঝখানে আপনাকে খুঁজে পেলাম। কিছু খুঁজছিলেন দাদা এখানে?’ বিরবির করে বলি “সেই সময়টাকে!”
“কিছু বললেন দাদা”।
"নাহ্ কিছু না, চল ফেরা যাক।”
ভিতরটা কেমন যেন করছে! ভীষনভাবে মন চাইছে সেই সময়টাতে ফিরে যেতে। জেঠিমার হাত ধরে সেই ফুলের বাগানঘেরা বাংলোর মতো বাড়ীটাতে বেড়াতে আসতে।
বেড়াতে আসবার সেই অনুভূতিটার ভীষণ অভাববোধ করতে লাগলাম। বুকের ভিতরে কেমন একটা অদ্ভুত কষ্ট বয়ে যেতে লাগল। তবে কি একেই বলে নস্টালজিয়া? নাকি আমাদের ভাষায় স্মরণবেদনা!
0 Comments